নতুন ভাইরাস "রিওভাইরাস" ।। রিও ভাইরাসের লক্ষণ ও প্রতিকার
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এবার রিওভাইরাস নামের একটি নতুন ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এই ভাইরাসটি কি কারনে হয়, ভাইরাস থেকে বাঁচার উপায়, লক্ষণ ও প্রতিকার সহ বিস্তারিত আলোচনা করব আজকের আর্টিকেলে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে দেশের ৫ জন ব্যক্তির শরীরে এ ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে। এই ভাইরাস কি করোনার মতো মহামারি রূপ ধারণ করবে নাকি এ ভাইরাস অতটাও গুরু ভাইরাস না সেই প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করব আজকের আর্টিকেলটি পড়ার মাধ্যমে।
পেজ সূচিপত্রঃ
রিওভাইরাস কি?
রিও ভাইরাস মূলত RNA বা রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড ভাইরাস। এটি রিও-ভাইরিটি গ্রুপের একটি ভাইরাস। এই গ্রুপের মধ্যে পরিচিত একটি ভাইরাসের নাম "রোটা ভাইরাস"।
রিও ভাইয়াটি গ্রুপের ভাইরাসগুলো DNA নয় বরং RNA ধারণকারী ভাইরাস। এ ভাইরাস গুলি প্রাথমিকভাবে মানুষ ও প্রাণী উভয়ের মধ্যে সংক্রামণি সৃষ্টি করতে পারে এবং বেশ কিছু উপজাতির বিভিন্ন ধরনের রোগের সৃষ্টি করতে পারে।
রিওভাইরাস সাধারণত ফিকাল-অরাল ট্রান্সমিশন বা ফলমূল, পানীয় মাধ্যম ও বায়ুবাহিত মাধ্যমে ছড়ায়।
বাংলাদেশে যেভাবে শনাক্ত হলো
গত বছরসহ বেশ কয়েক বছরে বাংলাদেশে শীতকালে কাঁচা খেজুরের রস খেয়ে অনেকের নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। নিপা ভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে আসা কয়েকজন ব্যক্তিদের পরীক্ষা করার পর তাদের নিপা ভাইরাস নেগেটিভ পাওয়া যায় তবে ওই ব্যক্তিদের প্রায় সবাই খেজুরের রস খেয়েছিলেন তাই গবেষণার জন্য তাদের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। আইইডিসিআর এর তথ্য মতে ওইসব রোগীদের যেহেতু নিপা ভাইরাস হয় নাই সেহেতু অন্য কোন ভাইয়েরা যে তারা আক্রান্ত কিনা সেটা পরীক্ষা করার জন্য নগরা সংগ্রহ করেছিল পরবর্তীতে পরীক্ষার পর বেশ কয়েকটি স্যাম্পল রিওভাইরাসে আক্রান্ত বলে জানান।
আইইডিসিআর এর পরিচালক তাহমিনা শীরিন বিবিসি বাংলার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, "যাদের শরীরে এই ভাইরাসটি পাওয়া গেছে তাদের সকলেরই খেজুরের কাঁচা রস খাওয়ার ইতিহাস আছে। নিপাহ ভাইরাসের কারণে তারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন"।
আইইডিসিআর মতে, খেজুরের রসের মাধ্যমে বাদুড় থেকে আসা অন্য কোন ভাইরাস আছে কিনা সেটা জানার জন্য বেশ কিছু নমুনা সংগ্রহ করা হয় এবং তা ল্যাবে পরীক্ষা করে কিছু কিছু নমুনায় কিছু কিছু নমুনায় রিওভাইরাস সনাক্ত করা হয়।
অধ্যাপক শিরিন বলে " রিওভাইরাস, নমুনা সংগ্রহ সহ এ বিষয়ে আরো গবেষণা করা প্রয়োজন। গবেষণা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই বিষয়ে আর কোন কিছু বলা যাচ্ছে না"।
রিও ভাইরাস কি নতুন?
রিওভাইরাস কি নতুন নাকি অনেক আগে থেকেই এ ভাইরাসটি আমাদের শরীরে বসবাস করছে? ভাইরোলজিস্টরা জানাচ্ছেন, রিওভাইরাস বাংলাদেশে প্রথম সনাক্ত হলেও এটি নতুন কোন ভাইরাস না। বিশ্বে আরও অন্তত ৭৫ বছর আগেই এই ভাইরাসের অস্তিত্ব মিলেছে। চলুন এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের বক্তব্য শুনে আসি।
অধ্যাপক সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন "ভাইরাসটি ১৯৫০ সালে পরীক্ষা করার মাধ্যমে প্রথম ধরা পড়েছে তবে পৃথিবীতে কবে থেকে আছে সেটা সঠিক ভাবে বলা সম্ভব না।" তিনি আরো বলেন "এখন যদি ১০০ জনকে পরীক্ষা করা হয় তাহলে এ ভাইরাসটি প্রায় ৫০ জনের মধ্যেই পাওয়া যেতে পারে"।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডাক্তার ফরহাদুল ইসলাম বলেন "এ ভাইরাস আগে থেকেই ছিল হয়তো কিন্তু কখনো নির্দিষ্টভাবে শনাক্তকরণের জন্য কোন ধরনের কোন পরীক্ষা করা হয়নি বলেই সনাক্ত করা যায়নি"।
চিকিৎসা গবেষকদের মতে এই পর্যন্ত বিশ্বে রিওভাইরাসের মোট ৯টি ধরন সনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে চারটি ধরন মানবদেহে সংক্রমণ ঘটাতে পারে আর বাংলাদেশে যেইও ভাইরাসটি ছড়িয়েছে সেটিও ভাইরাস নামে পরিচিত যা বাদুড় থেকে ছড়িয়েছে বলেই প্রাথমিক অবস্থায় ধারণা করা হচ্ছে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব রয়েছে বলে জানান আইইডিসিআর।
রিওভাইরাসের লক্ষন
রিও ভাইরাস ডিএনএ নয় বরং আরএনএ ধারণকারী ভাইরাস। এই রিও ভাইরাসের আলাদা বিশেষ কোন লক্ষণ দেখা যায় না। অন্যান্য ভাইরাসের মতোই স্বাভাবিকভাবে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে জ্বর, সর্দি-কাশি, মাথা ব্যাথা, হাচির মতো লক্ষণ দেখা দেয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে
- ডায়রিয়া
- বমি
- পেটব্যথা
- মাথাব্যথা
- শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা
- গ্যাস
- অস্বস্ত
ইত্যাদির মতো লক্ষণ বা উপসর্গ তৈরি হয়ে থাকে। শিশুরা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হইলে
- সর্দি
- বমি
- ডায়রিয়া
- ডিহাইড্রেশন ও
- দুর্বলতা
দেখা দিতে পারে।
চিকিৎসা ও সতর্কতা
বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো প্রিয় ভাইরাসের অস্তিত্ব মিলেছে তাই বাটটি কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। আমাদের দেশের পরীক্ষায় যারা ভাইরাস পজেটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন তাদের সবারই কাঁচা খেজুরের রস খাওয়ার ভিক্টোরিয়া দেখা গেছে। তাই এই ভাইরাস এড়িয়ে চলতে হলে খেজুরের রস কাঁচা না খাওয়াই ভালো। তবে কাঁচা খেজুরের রস খেতে হলে খেজুরের রসের সংস্পর্শে বাদুর বা রোগ বহনকারী কোন প্রাণী না আসতে পারে সেই বিষয়ে বিশেষ নজরদারি করতে হবে।
তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতে এই ভাইরাসটি নিয়ে একেবারে আতঙ্কিত হওয়া যাবে না এটা সাধারন একটি ভাইরাস সর্দি কাশি জ্বরের মতো চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করলে থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। কারণ বাংলাদেশে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সনাক্ত হওয়ার কারণে এ ভাইরাসের আলাদা কিংবা নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা বা ওষুধ নেই। এ বিষয়ে অধ্যাপক সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন এ ভাইরাসের কোন ভ্যাকসিন বা কোন চিকিৎসা না থাকার পিছনে মূল কারণ হলো এ ভাইরাসটি বড় কোন সমস্যা না।
শীতকালেই কি শুধু রিওভাইরাস হয়?
বাংলাদেশের যেহেতু রিওভাইরাস সর্বপ্রথম শীতকালে ধরা পড়েছে তাই অনেকেই মনে করতে পারেন এই ভাইরাসটি শুধুমাত্র শীতকালেই হয়। তবে এমন কোন তথ্য জানা যায়নি। রিওভাইরাস যেকোনো সময় মানুষ কিংবা যেকোনো পশুপাখি শরীরে সংক্রামিত হতে পারে। তবে ধারণা করা হচ্ছে শীতকালীনে কাঁচা খেজুরের রস থেকে অর্থাৎ, বাদুরের শরীর থেকে খেজুরের রসে এবং সেই খেজুরের রস খাওয়া ব্যক্তি শরীরে সংক্রামিত হচ্ছে। আর খেজুর রস চেয়েও তো শুধুমাত্র শীতকালেই পাওয়া যায় তাই বলে যেতেই পারে শীতকালে রিও ভাইরাস সংক্রামণের হার বেশি থাকবে।
ভাইরাস থেকে মুক্তির পূর্ব প্রস্তুতি
চিকিৎসক ও গবেষকদের মতে এটি একটি সাধারণ ভাইরাস যা মানব শরীরে তেমন কোন বিশেষ সমস্যার সৃষ্টি করবে না। এই ভাইরাসের ফলে জ্বর, সর্দি-কাশি, মাথা ব্যাথা, হাঁচি, পেটব্যথা এই জাতীয় সমস্যা সৃষ্টি করে। তাই ভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য নিচের দেওয়া বিষয়গুলো মনে রাখতে পারেন।
- কাঁচা খেজুরের রস খাওয়া থেকে বিরত থাকুন
- বিশেষত সতর্কতা অবলম্বন করে খেজুরের রস সংগ্রহ করে এবং ফুটিয়ে খাওয়া যেতে পারে।
- সরাসরি ফ্রিজের ঠান্ডা খাবার বা আইসক্রিম খাওয়া যাবে না।
- শীতকালে গরম পোশাক পরিধান করুন।
- সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে থাকা যাবে না।
- ধুলাবালি ও ডাস্ট এড়িয়ে চলুন।
- ভাইরাস সংক্রমিত প্রাণী এড়িয়ে চলুন।
- বাসা-বাড়ি ময়লা মুক্ত রাখুন।
- নিয়মিত কুসুম গরম পানিতে গোসল করুন।
- শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করুন।
তবে সকল গবেষক চিকিৎসকের মতে এই ভাইরাস নিয়ে কোন প্রকার দুশ্চিন্তাস্থ হওয়ার মত কোন পরিস্থিতি অথবা কারণ নেই।
ভাইরাস নিয়ে ইসলাম যা বলে
ভাইরাস বা মহামারির মতো সংক্রামক রোগকে একটি পরীক্ষা, সতর্কতা বা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বিপদ হিসেবে দেখা হয়। কুরআন ও হাদিসে এমন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা তুলে ধরা হলো:
- ধৈর্য ও আল্লাহর প্রতি ভরসা: ইসলাম শেখায় যে, কোন বিপদই আল্লাহর অনুমতি ছাড়া আসে না। সুতরাং, এমন সময়ে ধৈর্য ধারণ করা এবং আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখা অপরিহার্য। কুরআনে বলা হয়েছে: "নিশ্চয়ই আমি তোমাদের পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা এবং সম্পদ, জীবন ও ফসলের ক্ষতির মাধ্যমে। আর ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।" (সূরা বাকারাহ, ১৫৫)
- সংক্রমণ প্রতিরোধে সতর্কতা: হাদিসে মহামারির সময় বিচ্ছিন্নতা ও সুরক্ষা নীতি গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: "যখন তোমরা শুনবে যে কোনো স্থানে মহামারি ছড়িয়েছে, সেখানে প্রবেশ করো না। আর যদি তোমাদের অবস্থানস্থলে মহামারি দেখা দেয়, তবে সেখান থেকে বের হয়ো না।" (বুখারি: ৫৩৯৬)
- চিকিৎসার প্রতি গুরুত্ব: আল্লাহর উপর ভরসা করার পাশাপাশি উপযুক্ত চিকিৎসা নেওয়ায় উৎসাহিত করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: "প্রত্যেক রোগের জন্য ওষুধ আছে। সুতরাং ওষুধটি সঠিক হলে আল্লাহর হুকুমে রোগ সেরে যায়।" (মুসলিম: ৫৭০১)
- দোয়া ও তওবা করা: মহামারির সময় বেশি বেশি দোয়া করা, পাপ থেকে বিরত থাকা এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করাও ইসলামে সুপারিশ করা হয়েছে।
শেষ কথা
বাংলাদেশে নতুন সনাক্ত হওয়া ভাইরাস "রিওভাইরাস" এটি নিয়ে এখন বিভিন্ন নিউজ পত্রিকায় বিভিন্নভাবে খবর প্রচারণা করা হচ্ছে। তবে গবেষক ও চিকিৎসকদের মতে এ ভাইরাসটি নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করার কোন কারণ নেই। এটি সাধারণ একটি ভাইরাস যা সর্দি কাশি জ্বর গলা ব্যথা মাথা ব্যথার মত সাধারন রোগের চিকিৎসা করার মাধ্যমেই প্রতিকার করা সম্ভব তাই আতঙ্ক তার সৃষ্টি না করে সচেতন হন এবং সুরক্ষিত থাকতে সবাইকে সচেতন করুন।
শেষ পাতার কমেন্ট পলিসি মেনে কমেন্ট করুন।
comment url