নিপা ভাইরাস কেন হয়
বর্তমানে আতঙ্কের এক নাম নিপা ভাইরাস। প্রতিবছর বহু মানুষ নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত
হয়ে মৃত্যুশয্যায় ঢলে পড়ছে। কিন্তু এ নিপা ভাইরাস কি? এবং নিপা ভাইরাস কেন
হয়? সেই সকল বিষয় নিয়েই আজকের আর্টিকেল।
নিপা ভাইরাস বাংলাদেশের প্রথম কবে এসেছে, কিভাবে এসেছে, এ ভাইরাস কিভাবে ছড়ায়,
এ ভাইরাস থেকে বাঁচার উপায় কি? নিপা ভাইরাসের লক্ষণসমূহ এবং নিপা ভাইরাসের কোন
চিকিৎসা আছে কি-না এই সকল বিষয় নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করব আজকের আর্টিকেলে।
পেজ সূচিপত্রঃ
নিপা ভাইরাস কি
নিপা ভাইরাস একটি জটিলতম ভাইরাস যা মানুষ এবং প্রাণীর মধ্যে সংক্রমণ ঘটাতে
সক্ষম। এবং এটি আক্রান্ত ব্যাক্তির মাধ্যমেও ছড়াতে পারে। প্রতিবছর
নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে অসংখ্য মানুষ ও প্রাণীর মৃত্যু হচ্ছে। যদিও এটি
মহামারীর রূপ ধারণ করে নাই তবুও প্রচুর মানুষের মৃত্যুর কারণ নিপা ভাইরাস।
নিপা ভাইরাসের নাম ও গ্রুপ
- নাম: নিপাহ ভাইরাস ইনফেকশন
- বৈজ্ঞানিক নাম: Nipah henipavirus
- পরিবার: Paramyxoviridae
- জেনাস: Henipavirus
নিপা ভাইরাস কেন হয়
নিপা ভাইরাস একটি জেনেটিক ভাইরাস যা প্রাণী থেকে মানুষের শরীরে সংক্রামিত
হয়ে থাকে সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়ায় প্রাদুর্ভাবের সময় অসুস্থ শুকুর বা
তাদের দূষিত অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সাথে সরাসরি সংযোগ হওয়ার কারণেই বেশিরভাগ
মানুষের মাঝে এ ভাইরাসটি সংক্রামিত হয়েছিল। তবে বাংলাদেশ সহ আশেপাশের
দেশগুলোতে এ ভাইরাস এসেছে বাদুড়ের প্রস্রাব অথবা লালা দ্বারা দূষিত কোন ফল
বা খাবর (যেমন কাঁচা খেজুরের রস) খাওয়ার মাধ্যমে। পরবর্তীতে আক্রান্ত
ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার কারণে অন্যান্য মানুষের শরীরে এ ভাইরাস সংক্রমণ
হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
কিছু কিছু জায়গায় ভাইরাস সংক্রমণ স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে জড়িত
ব্যক্তিদের মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির মাঝে
ছড়ায়। যেখানে হাসপাতালে কর্মচারী, হাসপাতালে আসা অন্য রোগী বা তাদের
আত্মীয়-স্বজন সহ হাসপাতালে আসা অন্য ব্যক্তিদের মাঝে এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে
পড়ে। অর্থাৎ বলা যায় এ ভাইরাসটি অসুস্থ প্রাণী বাদুড় অথবা আক্রান্ত
ব্যক্তির কারনে হতে পারে।
বাংলাদেশে প্রথম নিপাহ ভাইরাস কবে এসেছে
নিপা ভাইরাস বাংলাদেশে প্রথম শনাক্ত হয় ২০০১ সালে। প্রথম অবস্থায় এটি
বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত খুলনা বিভাগের সীমান্তবর্তী জেলা
মেহেরপুর জেলায় নিপা ভাইরাস সনাক্ত করা হয়। এটি একটি প্রাণঘাতী ভাইরাস, যা
সাধারণত বাদুড়ের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়ায়। প্রথম প্রাদুর্ভাবের সময়
আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে উচ্চমাত্রার জ্বর, শ্বাসকষ্ট এবং মস্তিষ্কের
প্রদাহ দেখা গিয়েছিল।
আরো পড়ুন: রিও ভাইরাসের লক্ষণ ও প্রতিকার
নিপা ভাইরাস সংক্রমণের উৎস হিসেবে খেজুরের রস এবং বাদুড়ের মল-মূত্র দূষিত
খাবারকে দায়ী করা হয়। ২০০১ সালের পর থেকে এটি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে
মৌসুমি রোগ হিসেবে ফিরে এসেছে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) একে একটি
মারাত্মক উদীয়মান রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। নিপা ভাইরাস মোকাবেলায় সচেতনতা
বৃদ্ধি এবং সংক্রমণ প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নিপা ভাইরাস কিভাবে ছড়ায়
নিপা ভাইরাস বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়াইতে পারে তার মধ্যে অন্যতম কয়েকটি মাধ্যম
নিচে দেওয়া হল:
- বাদুড় থেকে: নিপা ভাইরাস মূলত ফলখেকো বাদুড় (flying fox) থেকে মানুষের মধ্যে ছড়াতে পারে। বাদুড়রা এই ভাইরাসটি তাদের সর্দি বা মূত্র দ্বারা পরিবাহিত করতে পারে। যদি মানুষের সাথে বাদুড়ের এসব নিঃসৃত পদার্থের সরাসরি যোগাযোগ হয়, যেমন ফল বা খাবারে মূত্র বা লালা লাগলে, তা থেকে ভাইরাস ছড়াতে পারে।
- সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে: নিপা ভাইরাস মূলত শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। এটি একটি এয়ারবোন ভাইরাস হয়ে থাকতে পারে, অর্থাৎ একজন সংক্রমিত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশি থেকে ভাইরাস বাতাসে ছড়িয়ে গিয়ে অন্য মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে। এবং প্রস্রাব, লালা বা বিমারির অন্যান্য পদার্থ (যেমন মুত্র, রক্ত) থেকে ছড়াতে পারে। অর্থাৎসং, ক্রমিত ব্যক্তির যে কোন ধরনের শারীরিক সংস্পর্শ থেকে এ ভাইরাসের সংক্রমণ হতে পারে।
- প্রাণী থেকে: নিপা ভাইরাস কখনও কখনও গবাদি পশুর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়াতে পারে। বিশেষ করে, শূকর (pig) বা উট এর মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং তাদের শরীর থেকে মানুষের শরীরে সংক্রমিত করে।
- খাদ্যের মাধ্যমে:এছাড়াও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ফল বা কাঁচা খেজুরের রস অথবা অন্য যে কোন ধরনের জীবাণুযুক্ত খাদ্যের মাধ্যমেও মানুষের মধ্যে নিপা ভাইরাস ছড়াতে পারে।
সব বাদুড় কি নিপা ভাইরাস বহন করে
সকল প্রজাতির বাদুড় বা সব ধরনের বাদুড় নিপা ভাইরাস বহন করে না। অর্থাৎ নিপা
ভাইরাস সংক্রমণ হওয়ার পিছনে নির্দিষ্ট এক প্রজাতির ফলখেকো বাদুড় দায়ী।
বিশেষ করে Pteropus genus নিপা ভাইরাসের প্রধান বাহক। এই প্রজাতির বাদুড়ের
মধ্যে কোন প্রকার অসুস্থতা ছাড়াই অর্থাৎ সব সময়ই নিপা ভাইরাস বসবাস করে।
তবে অন্য সকল প্রকার বাদুড় নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হইলে তা থেকে মানুষের
শরীরে সংক্রামিত হতে পারে।
আরো পড়ুন: লম্বা হওয়ার কার্যকরী উপায়
যে সকল বাদুড় সারা বছরই বিভিন্ন গাছের ফল খেয়ে থাকে তাদের শরীর থেকে সারা
বছর নিপা ভাইরাস সংক্রমিত হইলেও অন্যান্য বাদুড়ের শরীর থেকে বিভিন্ন মৌসুমে
নিপা ভাইরাস সংক্রামিত হয়ে থাকে। যেমন বিভিন্ন ফলের মৌসুম এবং শীতকালে
খেজুরের রসের মৌসুমে। বাদুড়ের লালা প্রসাব বা মল দ্বারা ফল বা খেজুরের রস
দূষিত হয় এবং সেই খেজুরের রস বা ফল খাওয়ার ফলে মানুষের শরীরে নিপা ভাইরাসের
প্রবেশ হয়।
নিপা ভাইরাস এর লক্ষণ
নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হইলে শরীরে সাধারণ কিছু লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দেয়।
নিপা ভাইরাসের লক্ষণগুলো সাধারণত ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ৫-১৪ দিনের মধ্যে
দেখা দেয়। তবে এ সকল উপসর্গগুলো দেখা দিলেই নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে
কিনা তা পরীক্ষা করা ছাড়া নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না। নিচে নিপা ভাইরাসের
সাধারণ কিছু লক্ষণ দেওয়া হলো:
- উচ্চ জ্বর
- প্রচণ্ড মাথাব্যথা
- শ্বাসকষ্ট
- মাথা ঘোরা বা দৃষ্টির সমস্যা
- মস্তিষ্কে প্রদাহ
- বিভ্রান্তি বা অসংলগ্ন চিন্তা
- উল্টানো বা বমি
- অবসাদ ও ক্লান্তি
- মাংসপেশি বা শরীরব্যথা
- অজ্ঞান বা কোমা
- মানসিক সমস্যা
- তীব্র পেটব্যথা
- গ্যাসট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যা
- সেন্সরি সমস্যা
নিপা ভাইরাসের কারণে কিছু রোগী মৃত্যুবরণ করতে পারেন, বিশেষত যদি দ্রুত
চিকিৎসা না করা হয়। তাই, নিপা ভাইরাসের কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত
চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
নিপা ভাইরাস থেকে বাচার উপায়
নিপা ভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য কিছু স্বাস্থ্য টিপস মেনে চলা খুবই
গুরুত্বপূর্ণ। নিপা ভাইরাস কেন হয় সেই বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করে নিচের
স্বাস্থ্য টিপস গুলো সাজানো হয়েছে:
- বাদুড় বা ফলখেকো পাখি থেকে দূরে থাকুন।
- কাঁচা খেজুরের রস খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
- বাইরে থেকে আনা ফল ভালভাবে ধুয়ে তবেই খান।
- স্বাস্থ্যকর ও জীবাণুমুক্ত খাবার খাওয়া নিশ্চিত করুন।
- সবজি বা ফল ভালভাবে ধুয়ে এবং সঠিকভাবে রান্না করে তবেই খান।
- শূকর বা অন্যান্য গবাদি পশুর সঙ্গে সরাসরি সংস্পর্শ থেকে বিরত থাকুন।
- এলাকায় নিপা ভাইরাসের আক্রমণ ঘটলে পোকামাকড় থেকে দূরে থাকুন।
- পশুদের শরীরের তরল, মূত্র বা লালার সঙ্গে সরাসরি সংস্পর্শ থেকে বিরত থাকুন।
- স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।
- হাঁচি বা কাশির সময় মুখ ঢেকে রাখুন।
- যদি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হয়, তবে আক্রান্ত বা সন্দেহভাজন রোগীদের কাছ থেকে দূরে থাকুন।
- ঘর এবং আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখুন।
- কোনো পশু অসুস্থ হইলে তাৎক্ষণিকভাবে পশু চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
- বিষাক্ত পদার্থ থেকে দূরে থাকুন।
- যদি নিপা ভাইরাসের লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
- পশুদের স্পর্শ করার পর এবং বাইরে থেকে আসার পরে ভালোভাবে ধুয়ে নিন।
নিপা ভাইরাসের চিকিৎসা
নিপা ভাইরাসের জন্য বর্তমানে কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষেধক বা চিকিৎসা নেই। এই
ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা প্রধানত উপসর্গ অনুযায়ী করা হয়।
শ্বাসকষ্ট, জ্বর, মাথাব্যথা এবং মানসিক বিভ্রান্তির মতো লক্ষণ দেখা দিলে তা
নিয়ন্ত্রণে চিকিৎসা দেওয়া হয়। রোগীদের পর্যাপ্ত পরিমাণে তরল খাবার গ্রহণ
নিশ্চিত করা এবং অক্সিজেনের মাত্রা ঠিক রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সংকটাপন্ন অবস্থায় রোগীকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করে
প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হয়।
এ ভাইরাস থেকে বাচতে কিছু ক্ষেত্রে অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধ যেমন রিবাভিরিন
ব্যবহার করা হতে পারে, তবে এর কার্যকারিতা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না।
এছাড়া, আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা এবং ব্যক্তিগত
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এই রোগের বিস্তার রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন
করে। তবে নিপা ভাইরাস প্রতিরোধে কার্যকর টিকা তৈরির জন্য এখনো গবেষণা চলছে।
তাই এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো এবং প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্তকরণ
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শেষ কথা
নিপা ভাইরাস কেন হয় শিরোনামের আজকের আর্টিকেলে নিপা ভাইরাস সম্পর্কে বিস্তারিত
আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। নিপা ভাইরাস অনেক পুরাতন একটি ভাইরাস হওয়ার পরেও এ
ভাইরাসের নির্দিষ্ট কোন ওষুধ বা ভ্যাকসিন এখনো পর্যন্ত তৈরি হয়নি তাই
জনসচেতনতা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই
সকলেই নিপা ভাইরাস থেকে বাঁচতে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন এবং নিপা
ভাইরাস এর লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
শেষ পাতার কমেন্ট পলিসি মেনে কমেন্ট করুন।
comment url