কুকি চিন কারা জেনে নিন
কুকি চিন কারা? কুকি চিন সম্প্রদায় নিয়ে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু নিউজ পত্রিকায় বিভিন্নভাবে খবর প্রচারণা চালানো হয়েছে। তবে এই সম্প্রদায় বসবাসকারী মানুষ কোথায় থাকে কি করে? কেনই বা এই সম্প্রদায়ের সম্পর্কে জানা দরকার।
আজকের আর্টিকেলে কুকি চিন সম্প্রদায় কোথায় থাকে, এরা কোন দেশের নাগরিক এই বিষয় সহ কোথায় থাকে এসেছে এবং অন্যান্য সকল বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করবো।
পেজ সূচিপত্রঃ
কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট
কুকিচিন একটি জাতিগোষ্ঠী যারা মূলত বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ ভারত ও মিয়ানমারে বসবাস করে। এদের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পরিচিতিও রয়েছে। এরা বিভিন্ন উপজাতির অন্তর্ভুক্ত। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক সময়ে "কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট" বা KNF নামে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর কারণে এই জনগোষ্ঠীর নামটি আলোচনা এসেছে। কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বম পার্টি নামেও পরিচিত। এরা বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিভাগের রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায় হত্যা, লুটপাট, মুক্তিপণ দাবি সহ একাধিক সন্ত্রাসী কার্যক্রমে লিপ্ত থাকায় এদেরকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করা হয়।
2017 সালে KNF রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় নয়টি উপজেলা নিয়ে বম, পাংখুয়া লুসাই, খুমি, ম্রো, ও খিয়াং জনগণের জন্য একটি পৃথক স্বাধীন বা স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। তবে তা সফল হয়নি। মিয়ানমার থেকে এদেরকে অস্ত্র সরবরাহ করা হইতো বলে জানিয়েছে বাংলাদেশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। সম্প্রদায়ের সশস্ত্র বাহিনীর নাম কুকিচিন ন্যাশনাল আর্মি বা KNA
কুকি চিনদের ইতিহাস
কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বাংলাদেশে ২০১৭ সালে বম জনগণের সদস্যদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠা কালে তাদের সদস্য ছিল প্রায় দুই হাজার। এ সম্প্রদায় বেশিরভাগ খ্রিস্টান। এরা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে বৈষম্যের অভিযোগ তোলে। কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার স্নাতক নাথান বম। তিনি পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাথে জড়িত ছিলেন বলে জানা গেছে। এবং ২০০৮ সালে কুকি-চিন জাতীয় উন্নয়ন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন এবং কুকি-চিন জাতীয় স্বেচ্ছাসেবকদের নামকরণ করেন। কুকি-চিন জাতীয় স্বেচ্ছাসেবকরা কুকি-চিন জাতীয় ফ্রন্টে পরিণত হবে। কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের চিফ অফ স্টাফ ভানচুন লিয়ান মাস্টার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষক।
কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট জুন ২০২২ এ রাঙ্গামাটি জেলার বেলাইছড়ি উপজেলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংখ্যা সমিতির একটি ক্যাম্পে হামলা চালায়। ঘটনাস্থলে ৩ জনের মৃত্যু হয়। এই ঘটনার পর একই বছরের অক্টোবর মাসে কুকি চিনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সহ অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের প্রস্তুতির জন্য বান্দরবান জেলা থেকে সমস্ত পর্যটকদের ফেরত পাঠানো হয়। এবং নভেম্বরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কবে চেন্নাই ফ্রন্ট এর বিরুদ্ধে একটি অভিযান শুরু করলে কুকি চিনের প্রায় ২৭০ জন সদস্য ভারতের মিজোরামে আশ্রয় নেয়।
পরের বছরের শুরুর দিকে RAB এর একটি অভিযানে বোমা তৈরির সরঞ্জাম, গোলা বারুদ, রাইফেল সহ অন্যান্য যুদ্ধের সরঞ্জাম উদ্ধার করে। তাদের অভিযানে কুকিচিনসহ তাদের সাথে জড়িত অন্যান্য সন্ত্রাসী সংগঠনের বেশ কিছু সদস্যকে আটক করা হয়।
কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মি
কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (KNA) হলো কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রান্টের সশস্ত্র শাখা। ১১ থেকে ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ বান্দরবান জেলা প্রশাসন জেলার KNA এর বিরুদ্ধে অভিযানের কারণে জেলায় পর্যটকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। ন্যাশনাল আর্মির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের সূচনা হয়। বাংলাদেশ আরমি রেব সহ অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনী ন্যাশনাল আর্মির বিরুদ্ধে বন্দুকযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ যুদ্ধের পর রুমা উপজেলায় খুবই চিন্ত্যা ন্যাশনাল আর্মির সদস্যদের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া গেছে।
২০২৩ সালের মার্চ মাসে কুকীচীন ন্যাশনাল আর্মি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি কনভয়কে আক্রমণ করেছিল যেটি চট্টগ্রামে গর্ভবতী মায়েদের জন্য চিকিৎসা কনভয়ে স্কট করেছিল অতর্কিত হামলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিমুদ্দিন ও দুই সেনা আহত হন। ন্যাশনাল আর্মি সড়ক নির্মাণকারী কয়েকজন শ্রমিককে অপহরণ করে এবং মুক্তিপণ পেয়ে তাদের কয়েকজনকে ছেড়ে দেয় কিন্তু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত সার্জনকেও অপহরণ করেছিল যিনি মূলত রাস্তা নির্মাণের ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছিলেন।
কুকি চিনদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ
- ১৯ এপ্রিল ২০২৪: রুমা উপজেলার বড়থলি পাড়া আর্মি ক্যাম্পের আওতাধীন পলি পাংশা পাড়ার মধ্যবর্তী স্থানের যাত্রী ছাউনি এলাকায় সেনাবাহিনীর কর্পোরাল রফিকুল ইসলাম কে গুলি করে।
- ২ এপ্রিল ২০২৪: রাতে এ গোষ্ঠীটির কিছু সদস্য রুমায় অবস্থিত সোনালী ব্যাংকের শাখায় ডাকাতি এবং ব্যাংকের ম্যানেজারকে অপহরণ, আনসার ও পুলিশ বাহিনীর প্রায় ১৪টি অস্ত্র লুট করে।
- ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪: কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট এর হুমকির মুখে বান্দরবানের থানচি, রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়।
- ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪: কেএনএফ সদস্যরা চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় উহ্লাচিং মার্মাকে গুলি করে আহত অবস্থায় ফেলে যায়।
- ১৬ জুলাই ২০২৩: রুমা উপজেলা থেকে সুজন চৌধুরী নামে এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।
- ১৬ জুন ২০২৩: পাইনুমপাড়া এলাকা থেকে আনুমানিক ৪০০ মিটার দূরে কুকিচিন দের পুতে রাখা ল্যন্ডমাইন বিস্ফোরণের শিকার হয়ে দুজন সৈনিক শরীরের বিভিন্ন অংশে স্প্লিন্টারের আঘাতে গুরুতর আহত হন। এবং পরবর্তিতে একজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
- ১৬ মে ২০২৩: রুমা উপজেলার সুংসুংপাড়া সেনা ক্যাম্পের আওতাধীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি টহল দলের উপর কেএনএফ সদস্যরা আইইডি বোমা বিস্ফোরণ ও অতর্কিত গুলিবর্ষণ করে। চিকিৎসারত অবস্থায় ২জন মৃত্যুবরণ করে এবং আরো দুজন কর্মকর্তা আহত হন।
- ১২ মার্চ ২০২৩: দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় মা ও শিশুদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের উদ্দেশে গমনকৃত দলের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সেনাবাহিনীর টহল দলের উপর কেএনএফ সদস্যরা অতর্কিত গুলি বর্ষণ করলে সেনাবাহিনীর মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। এ ঘটনায় আরও দুই সেনা সদস্য আহত হন।
- ১১ মার্চ ২০২৩: সড়ক নির্মাণ কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত বেসামরিক ঠিকাদার, মালামাল সরবরাহকারী এবং শ্রমিকদের নিকট থেকে দাবিকূত চাঁদা না পেয়ে ১২ জন শ্রমিককে অপহরণ করে কেএনএফ সদস্যরা।
এছাড়াও কুকিচিনরা বিভিন্ন সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক মানুষের উপর সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যায়।
শেষ কথা
শেষ পর্যায়ে এসে একটা কথা না বললেই নয় কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর কিছু অংশ এই সংঘাতে জড়িত হলেও তাদের বৃহৎ অংশ সাধারণ জীবনযাপন করে এবং তারা শান্তিপূর্ণভাবে নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষা করতে চায়। তবে KNF-এর কর্মকাণ্ডের কারণে এই জনগোষ্ঠীর প্রতি একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হচ্ছে, যা মূল জনগোষ্ঠীর জন্যও সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শেষ পাতার কমেন্ট পলিসি মেনে কমেন্ট করুন।
comment url