রাজশাহীর ইতিহাস ।। যে সব কারনে বিখ্যাত রাজশাহী

প্রতিটি জেলার নিজ নিজ কিছু গুণাগুণ বা ঐতিহ্য আছে। আজকের এই ব্লগের রাজশাহী বিভাগের সমস্ত জেলার গুনাগুন এবং রাজশাহীর কোন জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত সেই সাথে রাজশাহীর ইতিহাস নিয়ে সংক্ষিপ্ত কিছু আলোচনা করব।
আমরা এমন অনেকেই আছি যারা রাজশাহীতে বসবাস করি, জন্মগতভাবেই রাজশাহীর বাসিন্দা অথবা কর্ম বা পড়াশোনার জন্য রাজশাহীতে বসবাস করে থাকি অথচ এই রাজশাহী কোথায় থেকে আসলো, কেন এর নাম রাজশাহী হলো এই বিষয়ে কনো ধারনায় রাখি না। কিন্তু যেই এলাকায় বসবাস করছি, যেই এলাকার হাওয়া-বাতাস গায়ে লাগিয়ে পরিবেশের সাথে বড় হচ্ছি সেই এলাকা সম্পর্কে জানব না এটা কি করে হতে পারে?
আজকের এই আর্টিকেলটি পড়ার মাধ্যমে আপনি রাজশাহী সম্পর্কে আরো বেশি ধারণা পেয়ে যাবেন। মোটা দাগে আজকে রাজশাহীর ইতিহাস এবং যেসব কারণে রাজশাহী বিখ্যাত সেই নেই কথা বলব।

পোস্ট সূচিপত্রঃ

পূর্বনাম ও প্রতিষ্ঠা

রাজশাহীর জন্ম বা প্রতিষ্ঠার নির্দিষ্ট সাল সম্পর্কে মতবিরোধ রয়েছে, তবে আনুমানিক ১৮২৫ সালের দিকে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ প্রশাসনিক অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, প্রাচীনকালে রাজশাহী অঞ্চলে বিভিন্ন সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল এবং এটি মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন রাজবংশের শাসনাধীন ছিল। পূর্বে রাজশাহীর সদর দপ্তর ছিল বর্তমান নাটোর শহর এলাকায় এবং এর পূর্বনাম ছিল "রামপুর-বোয়ালিয়া" সেই নামনুসারে রাজশাহীর অন্যতম থানার নাম বোয়ালিয়া থানা।

নামকরণের ইতিহাস

রাজশাহী নামটি 'রাজা' এবং 'শাহী' শব্দ দুটি থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হয়। এই অঞ্চলে একসময় বেশ কয়েকজন রাজা শাসন করতেন, এবং এখানকার ভূমি ছিল সমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্যপূর্ণ। 'শাহী' শব্দটি এখানে "রাজা দ্বারা শাসিত ভূমি" বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। রাজশাহী মূলত এই অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী নাম এবং এর মানে দাঁড়ায় "রাজাদের শাহী বা রাজ্যের অঞ্চল"।

বিখ্যাত রাজশাহী অঞ্চলে বিখ্যাত রাজপরিবার ও তাদের শাসনকাল ছিল যাদের জন্য এই অঞ্চলের নাম "রাজশাহী" হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

রাজশাহীর আয়তন ও জনগন

উত্তরবঙ্গের বিশাল একটি অংশ নিয়ে গঠিত বিভাগ রাজশাহী। রাজশাহীর মোট আয়তন ১৮,১৫৪ বর্গ কি. মি.। ঘনবসতিপূর্ণ এই রাজশাহীর মোট জনসংখ্যার ২৯,১৩,৮৬৭ জন (২০২২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী)। রাজশাহীর ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় রাজশাহী বিভাগের জেলার সংখ্যা ছিল ১৬টি। ২০১০ সালে রংপুর অঞ্চলের ৮টি জেলা নিয়ে রংপুর বিভাগ গঠন করা হয় এবং রাজশাহী অঞ্চলের ৮টি জেলা নিয়ে বর্তমান রাজশাহী বিভাগ পুনঃগঠিত হয়।
বর্তমানে রাজশাহী বিভাগের জেলা সমূহ
  1. রাজশাহী
  2. নাটোর
  3. সিরাজগঞ্জ
  4. চাঁপাইনবাবগঞ্জ
  5. নওগাঁ
  6. বগুড়া
  7. পাবনা
  8. জয়পুরহাট
রাজশাহী বিভাগে আয়তনের দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় জেলা ন‌ওগাঁ। এবং জনসংখ্যার দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় বগুড়া জেলা। রাজশাহী বগুড়া শহর বাংলাদেশের প্রথম সারির শহর গুলোর অন্যতম।

শিক্ষা ব্যবস্থায় বিখ্যাত রাজশাহী

রাজশাহীতে বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রাচীন এবং তৃতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়। "রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়" অবস্থিত। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৯টি বিভাগ ১২টি অনুষদে বিভক্ত। এছাড়াও দেশ সেরা "রাজশাহী কলেজ" অসংখ্য স্কুল,কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা রাজশাহী শহরে সচল রয়েছে। এছাড়াও ২টি সরকারি পলিটেকনিক, মেডিকেল কলেজ, শারিরীক শিক্ষা কলেজ সহ অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিখ্যাত রাজশাহী শহরকে আরো বিখ্যাত করে তুলেছে।
রাজশাহীর ইতিহাসের সাথে জুড়ে থাকা অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে আছে বলেই রাজশাহী শহর শিক্ষা নগরী নামে পরিচিত।

কর্মসংস্থান

শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করেই রাজশাহীর অধিকাংশ কর্মসংস্থান গড়ে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয় সহ অন্যান্য স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদেরকে পুঁজি করেই বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা গড়ে উঠেছে। এছাড়াও রাজশাহীর বিসিক শিল্পনগরী এলাকায় বেশ কয়েকটি শিল্ক ফ্যাক্টরি সহ প্যাকেটজাত খাবার যেমন বিস্কুট, চানাচুর, কেক ইত্যাদি এবং বিভিন্ন মিষ্টান্ন তৈরির কারখানা রয়েছে। বিসিক এলাকার এই কারখানা গুলোতে কাজ করে রাজশাহীর অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।

একইসাথে রাজশাহীর স্থানীয় সহ আশে পাশের অনেক অঞ্চলের নিম্ন-মধ্যবৃত্ত পরিবারের মানুষ রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকায় ব্যাটারি চালিত রিকশা এবং ইজি বাইক চালানোর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন।

পর্যটনকেন্দ্রে বিখ্যাত রাজশাহী

বিখ্যাত রাজশাহী শহরে পর্যটন কেন্দ্রের অভাব নেই। কালের পরিবর্তনে রাজশাহীর ইতিহাসে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন পর্যটন কেন্দ্র এবং বাড়িয়ে তুলছে রাজশাহীর সৌন্দর্য। 
নগরীর মেইন মেইন সড়কে সড়ক বাতি নগরীতে সৌন্দর্যের আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এর পাশাপাশি প্রতিটি রাস্তার পাশে সবুজ গাছগাছালি শহরটিকে সবুজ করে তুলেছে বলেই রাজশাহীকে গ্রীন সিটি এবং রাজশাহীর রাস্তাঘাট সহ পুরো শহর পরিষ্কার আবর্জনা হীন হওয়ায় ক্লিন সিটি বলা হয়। 
রাজশাহীর কিছু উল্লেখযোগ্য পর্যটন কেন্দ্রগুলো হলো
  • চিড়িয়াখানা
  • জিয়া পার্ক
  • বরেন্দ্র জাদুঘর
  • পদ্মা গার্ডেন
  • মুক্তমঞ্চ
  • আই বাঁধ
  • টি বাঁধ
  • ভদ্রা পার্ক
উল্লেখিত পর্যটন কেন্দ্র গুলো সহ আরো অনেক পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে। মুল কথাই বলতে গেলে বিখ্যাত রাজশাহী পুরো শহরটাই একটি পর্যটন কেন্দ্র। যেখানে প্রতিনিয়ত মানুষের সমাগম থাকে বিশেষ করে ছুটির দিনে পর্যটকের ভিড় অতিরিক্তই হয়ে থাকে।

রাজশাহী সম্পর্কে আরো কিছু জানতে এবং জানাতে জয়েন করুন

যে সব কারনে বিখ্যাত রাজশাহীর জেলা সমূহ

প্রতিটি জেলার নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য, ইতিহাস ও বিখ্যাত হওয়ার পিছনে কিছু কারণ রয়েছে। রাজশাহীর ইতিহাসের এই পর্যায়ে সেগুলো নিয়েই আলোচনা করবো।
  • রাজশাহী জেলা
    • হিমসাগর, ল্যাংড়া এবং তোতাপুরি আম দেশের মধ্যে অন্যতম সেরা।
    • আমের জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিও রয়েছে।
    • রাজশাহী জেলা ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক সমৃদ্ধ অঞ্চল।
    • জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের সুতির কাপড়, তাঁতের পণ্য ও কাঁচামাল উৎপাদন হয়।
    • রাজশাহী জেলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর।
  • নাটোর জেলা
    • নাটোর জেলার ইতিহাস বহু পুরনো এটি বাংলা ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
    • নাটোর রাজবাড়ি ইতিহাসের একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা
    •  স্থানীয় শিল্প, সঙ্গীত, এবং নৃত্য বিভিন্ন সময়ে প্রশংসিত হয়েছে।
    • বড়াইগ্রাম এবং লালপুর অঞ্চলের নানা কৃষিভিত্তিক দৃশ্য অনেক জনপ্রিয়।
    • নাটোরে ঐতিহ্যবাহী সন্ন্যাসী মেলা, সওগাতী মেলা, ও অন্যান্য অনুষ্ঠান পালিত হয়।
  • সিরাজগঞ্জ জেলা
    •  নামকরণ হয়েছে সিরাজ উদ-দৌলার নামানুসারে।
    • সিরাজগঞ্জ জেলার পাট শিল্পের জন্য সুপরিচিতি রয়েছে।
    • শাহজালাল মাজার, বড়াল মন্দির সহ ঐতিহাসিক স্থান ও মন্দিরের আধিক্য রয়েছে।
    • যমুনা নদী, বাগাতিপাড়া অঞ্চলের চর এবং বিলাঞ্চল দর্শনার্থীদের জন্য আকর্ষণীয়।
    • সিরাজগঞ্জে বড়াল নদী সেতু একটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো।
  • চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা
    • চাঁপাইনবাবগঞ্জ বাংলাদেশের অন্যতম আমের উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।
    • এটি গৌড় বা গুপ্তিপুর নামক অঞ্চলের অংশ ছিল, যা মুসলিম শাসনামলে বিখ্যাত ছিল।
    • চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভৌগোলিক অবস্থানও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
    •  শাহজাদপুর ও বড়শিমলা মন্দির সহ বেশ কিছু পুরনো মন্দির এবং দুর্গ ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে।
    • পহেলা বৈশাখ, দুর্গাপূজা, ইদ সহ অন্যান্য ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসব এখানে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে পালন করা হয়।
  • নওগাঁ জেলা
    • নওগাঁর পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন এবং গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ স্থাপত্য।
    • দেশের আলু উৎপাদনেও এই জেলার বড় ভূমিকা রয়েছে।
    • পাট, তামাক, এবং মিষ্টি তৈরির শিল্প এই জেলার প্রধান বাণিজ্যিক ক্ষেত্র।
  • বগুড়া জেলা
    • গোবিন্দপুর এবং শাহজাদপুর প্রাচীন স্থাপত্য, মন্দির এবং মাজারের জন্য পরিচিত।
    • উত্তরবঙ্গের রাজধানী হিসেবে বগুড়া একসময় গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
    • বগুড়া জেলা বাংলাদেশের অন্যতম কৃষিপ্রধান জেলা।
    • বগুড়া জেলা বাংলাদেশের পাট শিল্পের একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
    • এছাড়া, বগুড়ার লোকসংস্কৃতি এবং নৃত্যশিল্পও জনপ্রিয়, যা স্থানীয় অনুষ্ঠান এবং উৎসবে প্রদর্শিত হয়।
  • পাবনা জেলা
    • বিখ্যাত লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর জন্মস্থান এবং ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে।
    • খানে প্রধান ফসল হিসেবে ধান, পাট, আলু, পেঁয়াজ, সবজি, এবং তামাক চাষ হয়।
    • পাবনা রাজবাড়ি একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা।
    • পাবনা জেলা শিল্পকলা এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও সমৃদ্ধ।
    • দেশের একমাত্র মানবিক হাসপাতাল এ জেলায় অবস্থিত
  • জয়পুরহাট জেলা
    • এখানকার উর্বর জমি এবং উপযুক্ত জলবায়ু কৃষির জন্য অত্যন্ত সহায়ক।
    • জয়পুরহাটে কিছু ঐতিহাসিক স্থান, শাহজাদপুর মন্দির এবং বড়ধলা মন্দির রয়েছে।
    • এছাড়া, ভরতপুর এবং পাগলা মাজারও কিছু ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে পরিচিত।
    • জয়পুরহাটে কিছু পুরনো এবং গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

শেষ কথা

সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশের প্রতিটি জেলার নিজস্ব ঐতিহ্য, ইতিহাস ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রয়েছে। একেক জেলার প্রকৃতি, আবহাওয়া, জলবায়ু এক এক রকম হওয়ায় সকল জেলা বিশেষ বিশেষ কিছু কারণে বিখ্যাত হয়ে থাকে। যে সব কারনে বিখ্যাত রাজশাহী শিরনামে আজকে রাজশাহীর ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত কাহিনি ও বিভাগের জেলা সমূহ বিখ্যাত হওয়ার কিছু কারণ নিয়ে আলোচনা করলাম। পরবর্তীতে অন্য কোন বিভাগের জেলা সমূহ নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব। আজকের আর্টিকেল নিয়ে কোন মন্তব্য থাকলে নিচে কমেন্ট বক্সে জানাতে পারেন।
পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কোনো কমেন্ট করা হয় নি
কমেন্ট করতে ক্লিক করুন

শেষ পাতার কমেন্ট পলিসি মেনে কমেন্ট করুন।

comment url